ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪ , ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

ঢাবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি

সাদিক কায়েমকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?

দৈনিক মার্তৃভূমির খবর
আপলোড সময় : ২২-০৯-২০২৪ ১১:৩৭:৫৫ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ২২-০৯-২০২৪ ১১:৩৭:৫৫ পূর্বাহ্ন
সাদিক কায়েমকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন মো. আবু সাদিক কায়েম। সমন্বয়কদের তালিকায় নাম না থাকলেও তিনি সরব ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের পাশেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন-পরবর্তী সময়ে সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা।

ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল ১০টি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। সেখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধি হিসেবে সাদিক কায়েমকে দেখা যায়। তিনি সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে এর ব্যাপক সংস্কারের দাবি জানান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাদিক কায়েম নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বলে পরিচয় দেন। পরে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্টও দেন তিনি। এই ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক যুগেরও বেশি সময় পর সরব উপস্থিতি জানান দিলো ইসলামী ছাত্রশিবির।

এরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে সাদিককে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। আওয়ামী লীগ শুরু থেকে দাবি করে আসছিল, এ আন্দোলনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে জামায়াত-শিবির। যদিও ছাত্রসংগঠনটি পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের এ দাবির বিরোধিতা বা সমর্থন করে কিছু বলা হয়নি।

সাদিক কায়েম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি শহরের বাজার এলাকায়। তার বাবা জেলা শহরের একজন কাপড় ব্যবসায়ী। তার ছোট ভাইও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।

ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সাদিক খাগড়াছড়ি বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ থেকে আলিম পাশ করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে।

মেধাবী এই তরুণ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ফলাফলে নিজ বিভাগের মধ্যে তৃতীয় হয়েছিলেন। স্নাতকে তার সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ৭৮। তবে স্নাতকোত্তরে তার সিজিপিএ কত ছিল সেটি জানা সম্ভব হয়নি।

সাদিক কায়েম পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি, হিল সোসাইটি সাবেক প্রতিষ্ঠাতা, সেভ ইয়ুথ-স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট ভায়োলেন্সের সাবেক ফ্যাসিলিয়েটর, সূর্যসেন হল অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ইয়ুথ ইনিশিয়াটিভ-বিওয়াইআইয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।

৯ দফায় সাদিকের ভূমিকা
সাদিকের স্ট্যাটাস দেওয়ার পর আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে ফেসবুকে লেখেন মোহাম্মদ ইশরাক নামের একজন। এরপর তা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।

মোহাম্মদ ইশরাক ফেসবুকে লেখেন, ‘নেট বন্ধ হওয়ার রাতে ৯ দফা ঘোষণা হয়। প্রথমে এটা ছিল ৮ দফা। আমাদের পরামর্শ ছিল যে এমনভাবে দফাগুলি দিতে হবে যাতে দাবীগুলি যৌক্তিক মনে হয় কিন্তু হাসিনার পক্ষে মানা অসম্ভব হয়। এর ফলে ১ নম্বর দফায় হাসিনাকে হত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলা হয়। অন্যসব দফা মেনে নিলেও হাসিনার পক্ষে এই দফা মেনে নেওয়া সম্ভবই ছিল না। কারণ হত্যার দায় স্বীকার করলে প্রধানমন্ত্রীত্ব থাকবে না, দেশে-বিদেশে হত্যা মামলায় জড়িয়ে যেতে হবে।

এরপর ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ভোরবেলায় জানতে পারি যে প্রথম আলোতে আমাদের পরামর্শমতই ৯ দফা এসেছে। অন্যদিকে দুইজন সমন্বয়ক আলাদা আপোষকামী ৮ দফা নিয়ে মন্ত্রীদের সাথে মোলাকাত করে।

এই ৯ দফা মুসাবিদা করেন ঢাবি শিবির সভাপতি ও সমন্বয়ক সাদিক কাইয়েম। পাঠানো হয় সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের নামে। ছাপানোর ব্যবস্থাও শিবির নিজের মেকানিজমে করে। বিন্দুমাত্র ক্রেডিট কিংবা পদের লোভ ছাড়া ঢাবি শিবির নিভৃতে কাজ করে গেছে।

আজকেও প্রথম আলোর সাংবাদিক সাদিক কাইয়েমকে জিজ্ঞেস করেছে যে তার নাম্বার থেকেই তো ৯ দফার মেসেজ এসেছে, এটা নিয়ে সে লিখছে না কেন। সাদিক জানিয়েছে যে এই মুহুর্তে এসব বলে বিপ্লবকে অস্থিতিশীল করা তাদের উদ্দেশ্য না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে ব্যাচে তৃতীয় স্থান অধিকার করে ব্যাচেলর ও মাস্টার্স সম্পন্ন করা সাদিক কাইয়েম সম্ভবত ঢাবি শিবিরের সাবেক রকস্টার সভাপতি মির্জা গালিবকেও ছাড়িয়ে গেছেন জুলাই বিপ্লবে তার অবদানের মাধ্যমে।’

সাদিককে ফেসবুকে লিখেছেন প্রবাসী সাংবাদিক শাহেদ আলম। তিনি লেখেন, ‘সাদিক’র শিবিরের সভাপতি ঘোষনা নিয়ে আমার আপত্তি নেই, আপত্তি যে সে নিজের পরিচয় গোপন রেখে সাধারন ছাত্রদের সাথে-জনতার ঈমানের প্রতি বেঈমানি করেছে। সমন্বয়করা অরাজনৈতিক জেনেই তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে সবাই। শিবিরের কারো ডাকে সাড়া দেয়নি। ছাত্রদের মধ্যে বাদবাকী কেউ শিবির থেকে থাকে তারাও ঘোষনা দিয়ে বের হয়ে যাক। অন্য দলের থাকলেও বের হয়ে যাক। এ ধরনের কাজ মোনাফেকি কাজ কারবার। সাদিক নিজে মোনাফেক, তার পরিচয় গোপন রেখে জামায়াত ও দল হিসেবে জাতির সাথে মোনাফেকি করেছে বলে আমি মনে করি।
নোট: অশোভন মন্তব্যকারীদের ব্লক করা হবে, যৌক্তিক মতামত স্বাগত।’

সাদিককে নিয়ে সাংবাদিক আবির হাকিম ফেসবুকে লেখেন, ‘কোভিডের পরে সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের এক বড় ভাই একদিন সাদিকরে (Shadik Kayem) পরিচয় করাইয়া দিছিলো। বলছিলো, সাদিক আমাদের এলাকার ছোটো ভাই। ছাত্রলীগের ফ্রেশ ইমেজের ছেলে। সামনে ওরে হলের নেতা বানাইতে হবে। আমি যেন দেখে রাখি।

সবকিছুই মানা যায় ভাই। কিন্তু ওরা যে শিবির হয়ে ফিরে আসতে পারে তা ভাবতে পারি নাই।’

আবির হাকিমের এই স্ট্যাটাসও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এক হাজারের বেশি মানুষ পোস্টটি শেয়ার করেন।

সাদিক কায়েমকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?

সাদিককে সালমান নামে চিনতেন সামি
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি সাদিক কায়েমকে সালমান নামে চিনতেন প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি।

সাদিককে নিয়ে জুলকারনাইন সামি তার ফেসবুকে লেখেন, ‘একটা স্ট্যাটাস লিখার জন্যে দুপুর থেকেই চিন্তা করছিলাম, বানরের তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উঠার মতো অবস্থা হয়েছিলো আমার সিদ্ধান্তের। এক ফুট উঠে তো আবার দুই ফিট স্লিপ করে নীচে নামে। স্বভাব যেহেতু এ ধরনের মতামত চেপে রাখার বিপক্ষে, তাই আমিও আর চেপে রাখতে পারলাম না। তৈলাক্ত বাঁশটা পার করেই ফেললাম।

ছেলেটাকে আমি চিনতাম সালমান নামে, পরিচয় জুলাইর ২৫ তারিখ থেকে, তারপর নিয়মিতই কথা হতো, আমার খুব কাছের বন্ধুদের একটা নেটওয়ার্ক অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সমন্বয়ককে নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করে। মূলত সালমানের সাথে কোঅর্ডিশন করেই সব আয়োজন করা হয়। বয়সে বেশ ছোট সালমানের সাথে বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয় আমার ও আমার বন্ধুদের। ডিবি কার্যালয় যখন সমন্বয়কদের শীর্ষ নেতৃত্ব আটক, তখন সালমান ও অন্যান্য সমন্বয়করা পুরো আন্দোলনের নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়। নিরাপদ আবাসে থাকা সবার সাথেই আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো, সত্যি বলতে কি সালমানের পুরো পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ দেখে আমি বেশ অবাকই হচ্ছিলাম। কতইবা বয়স তাঁর, হয়তো ২৪/২৫ হবে, তারপরও এই ছেলে যেভাবে সকল পরিস্থিতে আমার বন্ধুদের পরামর্শে ম্যানুভার করেছে এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ সব স্ট্রাটেজিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

এই তো কয়েকদিন আগেই কথা হলো সালমানের সাথে, কোন পরিবর্তনই নেই ছেলেটার মধ্যে, নিরহংকার সেই একই সালমান। অন্য সকল সমন্বয়কদের থেকে সালমান ও কাদের এই দুটো ছেলে একেবারেই ভিন্ন। দু'জনের নেতৃত্বই অত্যন্ত বলিষ্ঠ।

তো আজকে দুপুরে জানলাম সালমানের প্রকৃত নাম শাদিক কাঁইয়ূম, এবং তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি। অবশ্যই অবাক হয়েছি, বেশ অবাক হয়েছি। কিন্তু প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ না পেয়েও শিবির যে সালমানের (আমার কাছে সে সালমানই থাকবে), মতো একটা নেতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তার জন্যে সাধুবাদ জানাই।

ছাত্র রাজনীতি সুষ্ঠ ধারার গণতন্ত্রের জন্যে অত্যাবশ্যক, এবং তার সদ্ব্যবহার করে যে কোন রাজনৈতিক দলই যদি সালমান কিম্বা কাদেরের মতো তরুন-তরুনীদের এত ম্যাচিউর্ড নেতা/নেত্রী হিসেবে তৈরি করতে পারে, তাহলে মন্দ কি?’

পরে মন্তব্যের ঘরে জুলকারনাইন লেখেন, ‘একটা বিষয় ক্লারিফাই করি, সালমান যদি তখন আমার সাথে শিবিরে বা অন্যকোন রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে যোগাযোগ করতো, তখন আমি কিছুতেই আমার বিশ্বস্ত বন্ধুদের কাছে তাদের পাঠাতাম না। এর মধ্যে জড়িতই হতাম না। কিন্তু সালমান আমার কাছে এসেছিলো সাধারণ একজন ছাত্র হিসেবে যে তার বন্ধুদের জন্যে নিরাপদ আবাস খুঁজছিলো। যেহেতু আন্দোলনটা তখন একপ্রকারের গণঅভ্যুথানে রুপ নিয়েছিলো, সে কারণেই আমি সালমান, কাদের ও অন্যান্যদের সহায়তা করি। সালমান তার রাজনৈতিক পরিচয় লুকিয়ে অপরাধ করেছে নাকি বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে তা একমাত্র সাধারণ জনগনই বিচার করতে পারেন।’

শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের সময় সাদিক কায়েমের সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক রেজাউল করিম শাকিল। সাদিককে নিয়ে নানা আলোচনার পর শাকিল তার ফেসবুকে লেখেন, ‘Shadik Kayem ভাই ঢাবি শিবিরের সভাপতি- এটা জানার পর যারা feel cheated, তারা যখন পুরো মুভমেন্টের হিস্ট্রি জানবেন তখন কী করবেন? কীভাবে ৯ দফা আসলো, কেন শুরুতেই এক দফা দেওয়া হলোনা, কীভাবে আন্দোলন বারুদের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো, ইন্টারনেট অফ করে দেওয়ার পরও আন্দোলন কীভাবে চলমান থাকলো, কারা চলমান রাখলো, আবদুল কাদেরের নামে মিডিয়ায় কারা ৯ দফা পৌঁছাতে লাগলো, আবদুল কাদের কোথায় ছিল কারফিউ চলাকালীন ঐ সময়টা, এমনকি ৯ দফা পত্রিকায় দেখার আগে আবদুল কাদের নিজেও এ সম্পর্কে জানতো কিনা, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এটা কীভাবে ছড়িয়ে পড়লো, কারা ছড়ালো, হাসিনার সকল এজেন্সি মিলেও মূল ব্যক্তিদেরকে কেন ডিটেক্ট করতে পারলোনা, আসিফ নাহিদরা শেষ কিছুদিন কোথায় ছিল, কোত্থেকে এত ক্যালকুলেটিভ কর্মসূচি আসতে লাগলো, আন্দোলনের মূল দুটি স্পট উত্তরা ও যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলন কীভাবে এতোটা জোরদার হলো, মব কি নিজে নিজে তৈরি হয়েছে নাকি কেউ তৈরি করেছে- এগুলোর প্রত্যেকটির পেছনের ঘটনা যখন সামনে আসবে, তখন কি বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যাবেন?’

নিউজটি আপডেট করেছেন : Matribhumir Khobor

কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ